সেই সময়টা কি তবে পার হয়ে এল বাংলাদেশের ক্রিকেট? খুব অল্পই বোধ হয় ব্যাপ্তি হলো সময়টার। তবু তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণসময়! কিন্তু সেটি কি এখন অতীত হওয়ার পথে? স্বপ্নের বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটা কি তবে ভেঙে যাচ্ছে!
সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং চলমান পাকিস্তান সিরিজের ব্যর্থতা থেকে ভেসে আসা হাহাকারেই শুধু এমন ভাবনার অবতারণা নয়। ভাবনার কুপিতে তেল পড়েছে আরও আগেই। এখন শুধু তাতে আগুন জ্বলল। সে আগুনের আলোয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের পথটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনিশ্চিত, বন্ধুর এবং হতাশার ডালপালায় ছাওয়া সেই পথ।
২০০০ সালের গোড়ার দিকেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে আজকের রমরমা ছিল না। ক্রিকেটে এ দেশের স্বপ্নের সীমা তখনো একটা ভালো দল পর্যন্ত। ভালো দল বলতে প্রতিদিন ম্যাচ জিততে হবে, তা নয়। এমন একটা দল, যারা ভালো ক্রিকেট খেলবে, বড় দলকে মাঝেমধ্যে কাঁপিয়ে দেবে, দেশের ক্রিকেটপাগল জনতাকে জয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে কখনো কখনো জিতেও যাবে, দলে অন্তত গোটা চার-পাঁচেক খেলোয়াড় থাকবেন, যাঁরা ম্যাচ জেতাতে পারেন—এই তো!
সঙ্গে বাড়তি চাওয়া— বিশ্ব ক্রিকেটেও এ দেশের কারও কারও থাকবে তারকাখ্যাতি। বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা যেমন একসময় ইমরান, কপিল, হ্যাডলি হতে চাইতেন; এ দেশেও দু-চারজন তেমন ক্রিকেটার থাকবেন; ক্রিকেট দুনিয়া যাঁদের একনামে চিনবে।
২০০৭ সালে সবার অজান্তেই সেই স্বপ্নের ভিত গড়া হয়ে যায়। মাশরাফি বিন মুর্তজার নামটা ২০০১ সাল থেকে ছড়াতে শুরু করলেও ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই বছরে একে একে বাংলাদেশ দলে নাম লেখান মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ। এরপর তো এই পাঁচে মিলেই হয়ে যান বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’।
২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথম একসঙ্গে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বর্ণসময়ের পাঁচ সারথি। সেই থেকে একে একে ১১১টি ম্যাচে তাঁরা মাঠে নামেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তিন সংস্করণ মিলিয়ে এই ১১১ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ৫৪টিতে, ৫৩টিতে হেরেছে, ফলাফল হয়নি ৪ ম্যাচে।
জয়ের সংখ্যাটা যদি তবু কম মনে হয়, তাহলে আরও একটু পেছন ফিরে তাকাতে পারেন। ওই পাঁচজন একসঙ্গে জাতীয় দলে খেলার আগে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ২১৮টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল মাত্র ৪০টিতে, হার ১৭১ ম্যাচে।
২০০০ সালের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট সাফল্যের যে স্বপ্নটা দেখে এসেছে, সেটাই আসলে পূর্ণতা পায় পঞ্চপাণ্ডবের সময়ে। ২০২০-এর মার্চে সিলেটে ওয়ানডে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অলিখিত বিদায় হয়ে যায় মাশরাফির। পঞ্চপাণ্ডবের ইতিহাসেরও সেখানেই সমাপ্তি। ২০১৯ বিশ্বকাপে লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাই তাই হয়ে আছে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিব, তামিম ও মাহমুদউল্লাহকে একসঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ।
সেই ম্যাচের পর এ পর্যন্ত ৬৫টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের জয় ৩০টিতে, হেরেছে ৩৪টিতেই। অর্থাৎ, হারের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এই সময়ে শুধু যে মাশরাফিই দলে ছিলেন না তা নয়, বিভিন্ন কারণে বাকি চারজনকেও একসঙ্গে দলে পাওয়া গেছে কম ম্যাচেই।
২০১৯ বিশ্বকাপের পরও বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছে, ভালো খেলেছে। কিন্তু দল থেকে সেই সুর-তালটা যেন হারিয়ে যেতে থাকে। বিশ্বকাপ শেষে প্রকাশ্যে মাশরাফির নেতৃত্বের সমালোচনা করেন সাকিব। সমালোচনার জবাব সরাসরি না দিলেও পরে মাশরাফিও বুঝিয়ে দেন বিষয়টি তাঁর পছন্দ হয়নি। জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে মন-কষাকষি, ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বিরোধ—কিছুই আর পুরোপুরি গোপন থাকেনি এরপর। জিম্বাবুয়ে সফরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে মাহমুদউল্লাহর আকস্মিক অবসর, টি-টোয়েন্টির প্রতি তামিম ইকবালের অনীহা, বিশ্বকাপের দল নিয়ে বিতর্ক, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সমালোচনার জবাবে খেলোয়াড়দের পাল্টা ছোবল মারা সেসবেরই ধারাবাহিকতা।
পঞ্চপাণ্ডব-অধ্যায় যেমন মাশরাফি-বিয়োগে শেষ হলো, তেমনি এটাও স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একদিন সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের অধ্যায়ও শেষ হবে। হয়তো আরও কিছুদিন তাঁরা খেলবেন, তবে বাংলাদেশ দলে এই চতুষ্টয়কে আর এক সঙ্গে পাওয়ার সম্ভাবনা কমই। ওয়ানডেতে হয়তো তাঁদের একসঙ্গে পাওয়া যাবে, তবে সেটিও অনেক যদি-কিন্তুর ওপর নির্ভরশীল। আর খেললেও জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের মধ্যে আগের সেই ঐক্যটা থাকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। নানা কারণে তাদের সম্পর্কে চলে আসা শীতলতাই এমন সন্দেহের উদ্রেক করছে।
ক্রিকেটারদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং দলের সাম্প্রতিক বাজে পারফরম্যান্সের পর বিসিবির অনেক কিছুই নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনার কারণেও দলে জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়দের ভুমিকা বদলে যেতে পারে। সব মিলিয়ে কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনের সময়টা ভালো কিছু উপহার দেবে, এমন সম্ভাবনা কমই। এ দেশের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষদের বোধহয় এবার একটু বাস্তবতার মাটিতে নেমে আসার সময় হয়েছে।
মাহমুদউল্লাহ টেস্ট ছেড়ে দিয়েছেন, তামিম-মুশফিক টি-টোয়েন্টি আর কত দিন খেলবেন কে জানে, টেস্ট থেকে মাঝেমধ্যে বিশ্রাম চাইবেন সাকিবও। তা ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ব্যক্তিত্ব আর স্বার্থের সংঘাতে জড়াবে, ভবিষ্যতের চিন্তা করবে—এটাই স্বাভাবিক। এক পরিবারেই তা হয়, আর এটা তো একটা দল!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের সামনে যেটুকু পথ পড়ে আছে, এই সময়টাতে তাঁরাও নিজেদের ভবিষ্যতের চিন্তা করতেই পারেন। একসময় বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচেই যাঁরা ছিলেন অপরিহার্য, এখন বিসিবিও তাই তাঁদের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে।
কিন্তু বিকল্প কি আছে? সাকিব, তামিম, মুশফিকরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই জানান দিয়েছিলেন তাঁরা লম্বা রেসের ঘোড়া। সেই জেল্লাটাই যে নেই এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে! একেবারে নতুনদের কথা বাদ দিন, চার-পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন, এমন ক্রিকেটাররাও এখনো পারেননি জাতীয় দলে জায়গা পাকা করতে।
শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড়ের বিদায়ে ২০১২ সালের পর এ রকমই সময় এসেছিল ভারতের ক্রিকেটে। ড্যামিয়েন মার্টিন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ম্যাথু হেইডেনের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা চলে যাওয়ার পর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়া দলকেও। ভালো বিকল্প খেলোয়াড় হাতে ছিল বলেই ভারত, অস্ট্রেলিয়া পেরেছে সেই ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠতে।
বিসিবি এই জায়গাতেই ব্যর্থ। না পেরেছে তারা তারকা ক্রিকেটারদের ভালোভাবে সামলাতে, না পেরেছে যোগ্য বিকল্প তৈরি করতে। স্বর্ণসময়ের প্রথম বৃত্তটা প্রায় পূরণ করে ফেলেও তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। স্বপ্নের দল তো ভেঙে যাচ্ছে, আরেকটি স্বপ্নের সারথিরা যে এখনো দৃশ্যপটেই নেই!
সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা ব্যাটন তুলে দেবেন কাদের হাতে?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন