মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে ইতিহাস গড়ার দ্বারপ্রান্তে টাইগাররা। প্রথম ইনিংসে ১৩০ রানের লিড আর নিউজিল্যান্ডকে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬৯ রানে অলআউট করায় বাংলাদেশের দরকার মাত্র ৪০ রান। যা এনে দেবে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও বাংলাদেশের প্রথম জয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নেমেছে টাইগাররা।
আজ সিরিজের প্রথম টেস্টের শেষ দিনে নিউজিল্যান্ড ৫ উইকেটে ১৪৭ রান নিয়ে মাঠে নামে। অপরাজিত ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ রস টেলর। চতুর্থ দিনে এবাদত হোসেনের আগুন ঝরানো বোলিংয়ের মুখে যখন কিউই ব্যাটসম্যানরা খাবি খেয়েছেন, সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন টেলর। সঙ্গী ছিলেন স্পিনার রাচিন রবীন্দ্র।
সেই টেলরকে শুরুতেই সরাসরি বোল্ড করে প্যাভিলিয়নের পথ ধরান এবাদত। টেলর আউট হন ৪০ রান করে। টেলরকে আউট করার মাধ্যমে এবাদত পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ফাইফার। ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশের কোনো পেসার হিসেবে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি। এরপর মাঠে আসেন নিউজিল্যান্ডের ফাস্টবোলার কাইল জেমিসন। তাকেও রানের খাতা খোলার আগেই শরিফুলের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত করেন এবাদত। ৮ বল খেলে শূন্য রানে ফেরেন জেমিসন।
এবাদতের পাশাপাশি অন্য প্রান্তে আগুন ঝরানো বোলিং করেছেন তাসকিন। এবাদতের জোড়া আঘাতের পর তাসকিন ফেরান রাচিন রবীন্দ্র ও টিম সাউদিকে। ১৬ রান করে লিটনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রাচিন রবীন্দ্র। আর টিম সাউদি খাতা খোলার আগে বোল্ড হন।
নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ তখন ৯ উইকেটে ১৬১ রান পিচে আসেন ট্রেন বোল্ট। দুই চারে ৮ রান করে তাইজুলের হাতে দুর্দান্ত এক দিয়ে ফেরেন তিনিও। নিউজিল্যান্ড অলআউট হয় ১৬৯ রানে।
বোলিংয়ে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে এবাদত পান ক্যারিয়ার সেরা ৪৬ রানে ৬ উইকেট, তাসকিন ১৪ ওভার বল করে ৩৬ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। আর মিরাজ ২২.৪ ওভারে ৪৩ রানের বিনিময়ে নেন ট্রেন বোল্টের উইকেটটি।
দেশে কিংবা বিদেশে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে কখনো জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। সাফল্য বলতে ঘরের মাঠে পাওয়া ড্র। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সেই ড্র করাটাও যেন দূরের মরীচিকা। সেই বাংলাদেশই এখন জাগিয়েছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের আশা ছিল দেড়শ রানের লিড নেওয়ার। অল্পের জন্য তা হয়নি। তবে বছরের প্রথম টেস্টে রেকর্ড গড়ে বড় লিডই পেয়েছে বাংলাদেশ দল। স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের চেয়ে ১৩০ রান বেশি করে থেমেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। টাইগাররা ৪৫৮ রান করে অলআউট হয়। নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওভার ব্যাটিংয়ের রেকর্ড গড়েছে মুমিনুল হকের দল। বিদেশের মাটিতে এই প্রথম বাংলাদেশের প্রথম আট ব্যাটার ৫০+ বল খেলার রেকর্ড গড়লো।
১৩০ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নেমে শুরুটা বেশ ভালোই করেছিল নিউজিল্যান্ড। ইনিংসের প্রথম ৮ ওভারে স্কোরবোর্ডে যোগ করে ফেলে ২৫ রান। তবে নবম ওভারেই ১৪ রান করা লাথামকে বোল্ড করে দেন তাসকিন আহমেদ। আউট হওয়ার আগে কিউই অধিনায়ক করেন ১৪ রান।
এরপর আক্রমণে এসে দারুণ বোলিং করতে থাকেন এবাদত। ইয়ং-কনওয়ের বেশ ভালো পরীক্ষা নেন তিনি। দুইবার ইয়ংয়ের ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল স্লিপ অঞ্চল দিয়ে সীমানায় চলে যায়। একবার তার থাই প্যাডে লেগে বল জমা পড়ে লিটন দাসের গ্লাভসে। সেটিতে রিভিউ নিয়ে হতাশ হয় বাংলাদেশ।
তবে ইনিংসের ২৫তম ওভারে আর হতাশ হতে হয়নি। এবাদতের করা সেই ওভারের দ্বিতীয় বলে কনওয়ের বিরুদ্ধে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন করে বাংলাদেশ। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। রিপ্লেতে দেখা যায় বল প্যাডে আঘাত হানার আগে লেগেছে ব্যাটের ভেতরের কানায়।
কিন্তু প্যাডে আঘাত হানার পর গালি অঞ্চলের দিকে উড়ে যাওয়া বল সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে তালুবন্দি করেন সাদমান। ফলে লেগ বিফোর না হলেও ক্যাচ আউট পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ফলে দলীয় ৬৩ রানে ভাঙে দ্বিতীয় উইকেট জুটি। কনওয়ের ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান। এক ওভার পর আরেক ওপেনার উইল ইয়ংকে বোকা বানিয়েছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। কিন্তু তার ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগা বলটি গ্লাভসে নিতে পারেননি উইকেটরক্ষক লিটন। ফলে ৩১ রানে জীবন পেয়ে যান প্রথম ইনিংসে ৫২ রানের ইনিংস খেলা ইয়ং।
দ্বিতীয় সেশনের বাকি সময়টা নির্বিঘ্নেই পার করেন ইয়ং ও রস টেলর। তৃতীয় সেশনেও বোলিংয়ে দাপট দেখায় বাংলাদেশ। কিন্তু ফিল্ডিং ও রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখায় অপরিপক্কতা। ইয়ংয়ের থাই প্যাডে লাগা বলে কট বিহাইন্ড এবং টেলরের মাঝ ব্যাটে লাগা বলে লেগ বিফোরের রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। দুটির একটিতেও মেলেনি সফলতা।
শুধু রিভিউ বিভ্রাটই নয়, ফিল্ডিংয়েও হ-য-ব-র-ল অবস্থা করে টাইগাররা। ইনিংসের ৪২তম ওভারে মিরাজের বলে তুলে মেরেছিলেন টেলর। ডিপ মিড উইকেটে সহজ ক্যাচের সুযোগ ছিল সাদমান ইসলামের সামনে। কিন্তু বলের ফ্লাইট বুঝতে না পেরে সেটি ছেড়ে দেন সাদমান, ১৭ রানে বেঁচে যান টেলর।
এরপর ৫০তম ওভারে আসে রান আউটের সুবর্ণ সুযোগ। পয়েন্টের দিকে ঠেলে দিয়ে দ্রুত রানের জন্য ছুটেছিলেন ইয়ং-টেলর। কিন্তু মাঝ পিচ পর্যন্ত গিয়ে দুজনই ফিরে যান যার যার ক্রিজে। ততক্ষণে বল সাদমানের হাত ঘুরে বোলার এবাদতের হাতে চলে যায়। কিন্তু এবাদত সেটি স্ট্যাম্পে লাগাতে ব্যর্থ হন। ফলে ৩১ রানে আবার সুযোগ পান কিউই অভিজ্ঞ ব্যাটার।
ইনিংসের ৫২তম ওভারে বাংলাদেশের ১৩০ রানের লিড ছাড়িয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। এর পরপরই তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এবাদত ঝড়। প্রথম ইনিংসে ৫২ রান করা ইয়ং দ্বিতীয় ইনিংসে এগোচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু ৫৪তম ওভারের দ্বিতীয় বলে তাকে সরাসরি বোল্ড করে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন এবাদত। ইয়ংয়ের ১৭২ বলের ইনিংস থামে ৬৯ রানে।
ঠিক পরের বলেই নতুন ব্যাটার হেনরি নিকলসের বিপক্ষে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন করেন এবাদত। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। তাতে কী! ওভারের চতুর্থ বলে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে নিকলসের স্ট্যাম্প ছত্রখান করে দেন এবাদত, সঙ্গে সঙ্গে দেন ইনিংসে নিজের তৃতীয় স্যালুট।
এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে আনন্দের নহর বইয়ে দিয়েই থামেননি এবাদত। নিজের পরের ওভারে টম ব্লান্ডেলকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন তিনি। রিভিউ নিয়েও উইকেট বাঁচাতে পারেননি ব্লান্ডেল। নিকলসের মতো তিনিও খুলতে পারেননি রানের খাতা।
এবাদতের এই দুই ওভারের আগুনে ২ উইকেটে ১৩৬ রান থেকে ৫ উইকেটে ১৩৬ রানের দলে পরিণত হয় নিউজিল্যান্ড। তবে এরপর আর বিপদ ঘটতে দেননি রস টেলর ও রাচিন রবীন্দ্র। দিন শেষে টেলর ৩৭ ও রাচিন ৬ রানের অপরাজিত ছিলেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন